ভূতুড়ে মেস - আদিদার সাথে প্রথম সাক্ষাতের গল্প

 আদিদা সিরিজের প্রথম গল্প

(১) - তুলসীরাম পিজিতে আগমন


আমার কলকাতার বন্ধুদের মধ্যে এই ঘটনাটা যাদেরই বলেছি, কেউ বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আমি জানি, এই ঘটনা সর্বৈব সত্যি। ঘটনার শুরু আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যখন আমি প্রথমবার ব্যাঙ্গালোরে চাকরি খুঁজতে যাই।

নতুন শহর। অজানা সংস্কৃতি। ফলে আমি বেশি রিস্ক নিইনি। যশোবন্তপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রথমে এক ব্যক্তি কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে কাছাকাছি উত্তর ব্যাঙ্গালোরে ভালো পিজি কোথায় আছে। তিনি আমার চাকরীর জায়গা প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন। আমার উত্তর শুনে বললেন যে উত্তর ব্যাঙ্গালোরের থেকে দক্ষিণ ব্যাঙ্গালোরে থাকলে আমার চাকরিস্থল কাছাকাছি হবে। এবং বললেন এইচ এস আর লেআউটের একটি ভালো পিজি আছে যেখানে সব কর্মরত ছেলেরা থাকে। আমি সেখানে গিয়ে খোঁজ করতে পারি। ঘর যে কোনও সময় পাওয়া যায়। যদিও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ছেলেরা এই পিজি ছেড়ে চলে যায়। 

আমি বললাম, "আপনি যখন পিজি সম্বন্ধে এত কিছু জানেন তখন মনে হয় আপনার বোধহয় কোনো ব্যক্তিগত পরিচিতি আছে পিজির মালিকের সাথে।"

ভদ্রলোক হাসলেন। তিনি বললেন, "না, পিজির মালিকের সাথে আমার কোনও পরিচয় নেই। কিন্তু হ্যাঁ, আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী ওই পিজিতে ছিল। সেই ছেলেটি ছিল তেলেগু। সেও ভিন রাজ্য থেকে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করতে এসেছিল। প্রথম কয়েক মাস সে ওই পিজিতে ছিল। তারপর চাকরি পাকা হওয়ার পরে সে ওই পিজি ছেড়ে অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে যায়। ওই পিজির ভালো দিকগুলো সম্বন্ধে সে আমাকে বিশদে বলেছিল। ওখানে নাকি তিন বেলাই খাবার দেয়। ঘরগুলো টু রুম শেয়ারিং। একতলার ঘরে বড় টিভি আছে এবং একাধিক ওয়াশিং মেশিনও আছে।"



ভদ্রলোকের কথা শুনে বেশ ভালো লাগল। আমার নিজের বাড়িতে কখনো ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করিনি। পিজিতে করা যাবে শুনে বেশ খুশি হলাম। কিন্তু এত সুবিধা যখন দিচ্ছে তখন ভাড়াটাও নিশ্চয়ই খুব বেশি হবে ৷ ভদ্রলোকের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে সেই পিজিতে গিয়ে পৌঁছলাম। পিজির নাম তুলসীরাম পিজি। 

ভাড়া সম্পর্কে আমার ধারণা যে ভুল ছিল সেটা পিজিতে গিয়েই টের পেলাম ৷ পিজির মালিক নামমাত্র ভাড়ায় আমাকে দোতলায় ঘর ছেড়ে দিলেন। ভাড়ার সাথে অ্যাডভান্সও বেশ কম। এছাড়া আমাকে সুযোগ দেওয়া হল যাতে আমি দুই-তিনটে ঘরের মধ্যে নিজের পছন্দমত ঘরটি বেছে নিতে পারি৷ এত সুবিধায় পাওয়ার পরে যেটা দেখে আরও খুশি হলাম সেটা হল প্রতিটি ঘরেই বেশ ভালো বালিশ-বিছানা-চাদর রয়েছে৷ ঘরের মধ্যে জামা কাপড় টাঙানোর জন্য দড়ি রয়েছে। দেওয়ালে ঝুলতে থাকা হুকের মধ্যে বেশকিছু হ্যাঙারও আছে৷ এছাড়া ঘরের কোণে রয়েছে দুটো বড় বড় লকার যাতে ঘরের ভাড়াটেরা নিজেদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখতে পারে। লকারগুলোতে তালা দেওয়ার জন্য তালা-চাবিও পাশে রাখা আছে ৷ এর পরে আর কী চাই! টুক করে একটা ঘর নিয়ে নিলাম।

দুপুরে খাবার পরে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে এলো ৷ নরম বিছানায় শুয়ে ঘুম লাগালাম ৷ কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানি না। কিন্তু একটা মেলায়েম স্পর্শে ঘুমটা ভেঙে গেল। স্পর্শটা কার বা কিসের জানি না। কিন্তু কিন্তু সেটা এমনই ছিল যার সাথে শরীরের চামড়ার সংযোগে আরাম, অস্বস্তি উভয়ই হয় ৷ সেই অদ্ভুত স্পর্শের প্রভাবে আমার ঘুমটা চট করে ভেঙে গেল ৷ ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করলাম ঘরের মধ্যে যেন মৃদু আলোড়ন হল। কী যেন একটা আমার বিছানার পাশে ঘোরাফেরা করছিল এতক্ষণ। কিন্তু আমি উঠতেই সেটা কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল! কী হতে পারে? কোনও বেড়াল বা ইঁদুর? আমি বিছানা থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকালাম৷ কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না৷ একবার খাটের নিচে উঁকি দিয়েও দেখলাম। না, কোথাও কিছু নেই। বিকেলের মরা আলো জানলা দিয়ে একটু-একটু ঢুকছে ৷ ঘরে জড়ো হয়েছে চাপ-চাপ অন্ধকার ৷ গাটা কেমন ছমছম করে উঠল৷ তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বাললাম৷ না, এবারেও কিছু চোখে পড়ল না। পুরোটাই কি তবে স্বপ্নের কাল্পনিক অনুভূতি? 

ঘরের দরজা খুলে বাইরে এলাম। এতক্ষণ একটা ব্যাপার খেয়াল করিনি। এবার খেয়াল হল। বাড়িওলা আমায় যে ক'টা ঘর দেখিয়েছিল, কোনও ঘরেই কেউ ছিল না। এই পিজিতে এমনিতেই ছেলেদের সংখ্যা কম। তার ওপর দোতলার যে দিকটা আমি আছি, সেদিকে সব ঘরই প্রায় তালাবন্ধ বা খালি। ভাবলাম বাড়িওলার সাথে কথা বলি যে ঘর বদলাতে চাই। কিন্তু ঘর বদলানোর কারণ কী বলব? আমার একা থাকতে ভয় করে বললে তো বাড়িওলা হেসেই মরে যাবেন। তার থেকে বলা ভালো যে আমি বন্ধু-বান্ধব পছন্দ করি। একা-একা বিরক্ত লাগছে। তাই অন্য কারুর ঘরে থাকলে গল্প করে বেশ সময় কেটে যাবে। 

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। নিচে একতলায় পিজির মালিকের ঘরে এলাম। পিজির মালিক বলে ভদ্রলোক আরাম করে জীবন কাটান না। আমি দেখলাম যে তিনি রাতের রান্নার জোগাড় করছেন। অন্য একটি ছেলের সঙ্গে বসে আলু কাটছেন। আমার দেখে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, "কী হয়েছে? কিছু লাগবে?"

আমি বললাম, "আজ্ঞে, আমার রুমে একা একা থেকে বিরক্ত হচ্ছি। তাই ভাবলাম যে যদি এমন কোনও রুমে থাকা যেত যেখানে অন্য কোনও ছেলে থাকে, তাহলে বেশ ভালো হত। একজন গল্প করার লোক মিলত।"

পিজির মালিক কিছুক্ষণ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। মনে মনে কী ভাবলেন কে জানে! তারপর বললেন, "অন্য সব রুমই হয় পুরো খালি অথবা দুজন করে রুমমেট আছে। অবশ্য একটা রুমে একজন আছে। সেখানকার রুমের ছেলেটা তার বাড়ি গিয়েছিল এই সপ্তাহ দুয়েক আগে। আগামীকালই ফেরার কথা। তার সাথে থাকতে পারেন। তবে..."

আমি অবাক হয়ে বললাম, "তবে কী?"

বাড়িওলা গলা নামিয়ে বললেন, "ছেলেটা একটু পাগল আছে। কী সব ভুতুড়ে বই-পত্তর পড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে কী সব মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে। ওকে আমি অনেক বার এসব করতে বারণ করেছি, কিন্তু শোনে না। ওর সাথে থাকলে আপনার ঘুমের অসুবিধে হবে।"

আমি বললাম, "ঠিক আছে। আমি তাহলে আজকের দিনটা ভেবে দেখি। কাল সকালে আপনাকে জানিয়ে দেব যে রুম চেঞ্জ করব কিনা।"


(পরের পর্ব আসছে)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আন্তির্জাতিক নারীদিবসের উৎস ও প্রয়োজনীয়তা

বাংলা অডিও গল্প - ভৌতিক, হরর, থ্রিলার ও অন্যান্য

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার অবক্ষয় নিয়ে কিছু কথা