আর জি করের ঘটনা থেকে যা বুঝলাম

 আর জি করের ঘটনা থেকে এখনও পর্যন্ত যা যা দেখলাম শিখলাম

১) জুনিয়র ডাক্তাররা ভদ্র ও শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করতে জানে। আমি ভেবেছিলাম যে পুলিশের সাথে তাদের সম্মুখে সাক্ষাত বুঝি শারীরিক বলপ্রয়োগ বা হানাহানি দিয়ে না শেষ হয়! আমার আশঙ্কা যে সত্যি প্রমাণ হয়নি, তাতে আমি খুব খুশি।

২) প্রতিবাদীদের অধিকাংশেরই ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই! তারা ভেবেছিল যে সিনেমায় যেমন দেখায়, তেমন ভাবে বুঝি এক সপ্তাহের মধ্যে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে! সেসব ভেবেই তারা সকাল-বিকেল-রাত্রিতে ফেসবুকে পোস্ট করছিল। তারপর যথারীতি বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় আপাতত প্রতিবাদী পোস্ট করা অনেকটাই কমে এসেছে।

৩) পুলিশ ও মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে ঠান্ডা মাথায় প্রতিবাদী জুনিয়ার ডাক্তারদের সাথে কথা বলেছে, বা পরিস্থিতি সামলেছে, সেটা শিক্ষণীয়।

৪) ফেসবুকের বাঙালি জনগণ দেখিয়ে দিল যে ধর্ষণ নিয়েও কন্টেন্ট মার্কেটিং করা যায়। (কী লজ্জা!) যেভাবে প্রতিবাদের নাম করে এক একজন ব্যক্তি নিজেদের পোস্টের লাইক-শেয়ার-কমেন্ট বাড়িয়েছে, সেই মানসিকতাকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই।

৫) আর জি করের ঘটনার পরে গোটা রাজ্যে এবং দেশজুড়ে আরও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সেসব নিয়ে কোনও প্রতিবাদ হয়নি (অন্তত ফেসবুক বা টিভি চ্যানেলে তেমন প্রতিবাদ চোখে পড়েনি)। তার মানে কি ধরে নেব যে কলকাতার বাঙালি বা ফেসবুকের বাঙালিরা শুধু একটি ধর্ষণেরই প্রতিবাদ করতে জানে? বাকি ধর্ষণের ঘটনায় চোখে ঠুলি পড়ে অন্ধ সেজে বসে থাকে? সরল ও সৎভাবে প্রতিবাদী মানুষ যেমন আছে, তেমনি মেকী ও হুজুগে প্রতিবাদীও আছে।

৬) পশ্চিমবঙ্গের বিরোধীদলের অনেক কর্মীই বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ইস্যু খুঁজছিল। তারা সেই ইস্যুটা খুঁজে পেয়েছে।

৭) মূল প্রতিবাদের বিষয় ছিল #JusticeForRGKar। সেটা এখন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। এখন মূল বিষয় হল ডাক্তারদের নিরাপত্তা ও অন্যান্য দাবি।

৮) যেসব মানুষ সক্রিয়ভাবে ফেসবুকে বা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেনি, তাদেরকে নির্মমভাবে ফেসবুকে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীরা অপমান করেছে। এমনটা একাধিকবার বলা হয়েছে যে যারা প্রতিবাদে সামিল হচ্ছে না, তারা নাকি ধর্ষকদের পক্ষে!!!! মানে, মানুষের ব্যক্তিগত সমস্যা থাকবে না, অফিস-ব্যবসা থাকবে না, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না, সংসারের কাজ থাকবে না, তাদেরকে যখনই বলা হবে, সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে রাস্তায় প্রতিবাদে সামিল হতে হবে, কিংবা ফেসবুকে প্রতিবাদী পোস্টে রিয়াক্ট করতে হবে। নইলেই তারা ধর্ষকদের সমর্থক হয়ে গেল! এই ধরণের কিছু অযৌক্তিক গুন্ডাদের ফেসবুকে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেছে।

৯) অনেকেই বলাবলি করছেন যে শিরদাঁড়া নাকি বাঙালির মনে নতুন করে ফিরে এসেছে। জুনিয়ার ডাক্তারেরা বিনীত গোয়েলকে প্রতীকী শিরদাঁড়া উপহার পর্যন্ত দিয়েছেন!

আমার বক্তব্য হল তাই নাকি, শিরদাঁড়া পোক্ত হয়েছে নাকি বাঙালির?

বাঙালির শিরদাঁড়া ছিল নেতাজী-রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগরের সময়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী কয়েক দশকেও বাঙালির শিরদাঁড়া ছিল। কিন্তু যবে থেকে বাঙালি নিজের শহরটাকে আস্তে আস্তে বিহারী-মারোয়াড়িদের গছিয়ে দিতে শুরু করল, বাঙালির শিরদাঁড়া হারিয়ে গেল, বিকিয়ে গেল। শিরদাঁড়া থাকলে কখনও বড়বাজারের মতো ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্রকে কেউ অবাঙালিদের একপ্রকার দান করে দেয়!

আজ শ্রীভূমি-লেকটাউন সহ কলকাতার বহু জায়গায় দ্রুতগতিতে অবাঙালিদের সংখ্যা বাঙালিদের থেকেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আর এই সব জায়গার আদি বাসিন্দারা নিজেদের জায়গা ছেড়ে শহরতলি বা অন্যত্র পালাচ্ছে। হ্যাঁ, পালাচ্ছে!

সুতরাং আর জি কর কাণ্ডে যে শিরদাঁড়া গজিয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সেটা হল একটি প্রতিবাদের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া। বাঙালি যে নিজের শহর কলকাতা থেকেই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে, সেটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বা অবাঙালিদের থেকে কলকাতা শহরের পুনরায় দখল নেওয়ার মতো শিরদাঁড়া বাঙালির নেই। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আন্তির্জাতিক নারীদিবসের উৎস ও প্রয়োজনীয়তা

বাংলা অডিও গল্প - ভৌতিক, হরর, থ্রিলার ও অন্যান্য

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার অবক্ষয় নিয়ে কিছু কথা