কলকাতা বইমেলা ২০২২

বাঙালির চোদ্দতম পার্বণঃ বই-পার্বণ

কলকাতা বইমেলা ২০২২


একটা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গেটটার মাথার ওপর দিয়ে গলিত সোনার মতো সূর্যালোক মুখে এসে পড়ছে। রোদের তেজ বলছে বসন্ত ক্ষণিকের। গ্রীষ্মকাল সমাগত প্রায়। কিন্তু গরমের কষ্ট কিছুই অনুভূত হচ্ছে না। বইমেলার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি কিনা! দু'বছর পরে কলকাতা বইমেলায় প্রবেশের আনন্দে দুপুরের রোদের তীব্রতাকে অবজ্ঞা করা যায়।

আলোকচিত্রীঃ বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

২০২২ এর বইমেলায় ৩ নম্বর গেট দিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে ডানদিকে যেতেই পালক পাবলিশার্সের স্টল। সেখানে নতুন বইগুলো দেখে নিয়ে চলে গেলাম অন্যান্য প্রকাশনীর স্টলগুলো দেখতে দেখতে। দেখা হল অরণ্যমন প্রকাশনীর চিরঞ্জীৎ দাস এবং শব্দ প্রকাশনীর বিকাশ কল্পের সাথে। কিনলাম সৈকত মুখোপাধ্যায়ের শিম লতার নূপুর। সৈকতবাবু যেন শব্দে নূপুর বাজিয়ে চলে গেছেন। এমনই কাব্যিক গদ্য তাঁর। এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে গেল সৈকতবাবুর সাথেও। সেখান থেকে এদিক-ওদিক দিশাহীনভাবে হেঁটে বেড়াতে বেড়াতে দেখা হয়ে গেল রূপম প্রকাশনীর অতনু সোমের সাথে। 

চারদিকে নজরে এল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত কোলাহল। সুন্দরী মহিলা ও স্মার্ট যুবকেরা হাত ধরাধরি করে বই কিনতে বেরিয়েছেন। নর ও নারীর প্রেমকাহিনির যোগসূত্র হয়ে উঠেছে বই। 

দেখা হল কিছু লেখকবন্ধুর সাথে। বেশ কয়েকজনের নতুন বই বেরিয়েছে। লেখকেরা কেউ পাঠকের সাথে গল্প করছেন, ছবি তুলছেন, কেউ বা বইতে নাম সই করছেন আবার কেউ প্রকাশকের সাথে বা অন্য লেখক বন্ধুর সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। লেখকের সাথে পাঠকের যোগাযোগের এত বৃহৎ ক্ষেত্র বুঝি আর হয় না। বইমেলা লেখক ও পাঠকদের মিলিত পার্বণ।

আলোকচিত্রীঃ বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়


বইমেলা বাঙালি জাতির এক সম্মিলিত আবেগ হয়ে উঠেছে। লকডাউন পরবর্তী এক বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের নাম হল বইমেলা। বইমেলা এক অভাবনীয় মিলনোৎসব। এক অতিকায় লাইব্রেরি। এক আকাশ জোড়া জ্ঞান আদান-প্রদানের ক্ষেত্র। বইমেলা হল ধুঁকতে থাকা প্রকাশকের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার নাম। 

কত নতুন-নতুন প্রকাশনা সংস্থা আছে, যাদের নামই জানি না।  বইমেলার স্টল থেকে এই সব প্রকাশকের নাম জানা যায়। কত প্রকাশনার দোকান আছে কলেজ স্ট্রীটে, অথচ তাদের দোকানে সারা বছর যাওয়াই হয় না। কিন্তু বইমেলায় মেলার ম্যাপ দেখে দেখে ঠিকই তাদের স্টলে পৌঁছে যাওয়া যায়। এইটাই হল বইমেলার মজা। এছাড়া, কত অনামী কবিকে খুঁজে পাওয়া যায় বইমেলার স্টলে।

যেন হাতে ম্যাপ নিয়ে গুপ্তধন খুঁজছি। গুপ্তধন হল অজানা প্রকাশক বা প্রকাশনী সংস্থাকে আবিষ্কার এবং তাদের বই সংগ্রহ করা। 

পরিচিত স্টলগুলি, যেমন পত্রভারতী, আনন্দ, মিত্র ও ঘোষ, দেজ়ে ভিড় উপচে পড়ছে। প্রকাশনা সংস্থাগুলোরও উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখার মতো। দু'বছর পরে বইমেলা হওয়ার জন্য তাঁরা পাঠককূলকে সাদরে অভ্যর্থনার করবার জন্য বসে আছেন। 

আমি যত বইমেলার ভেতরে ঘুরছি, ততই যেন হারিয়ে যাচ্ছি। মাথার ভেতরে চিন্তাস্রোত এলোমেলো খেলা করছে। এত বই, পাতার ভেতরে এত লুকিয়ে থাকা জ্ঞান, এত মানুষের বইকে ঘিরে পরিশ্রম, ভালোবাসা - এসব দেখার জন্যই তো বইমেলায় আসা। যদি অকৃত্রিম ভালোবাসা বলে কিছু থেকে থাকে, তবে তা মানুষের সাথে বইকে ঘিরে সম্পর্ক, অন্য কিছু নয়। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আন্তির্জাতিক নারীদিবসের উৎস ও প্রয়োজনীয়তা

বাংলা অডিও গল্প - ভৌতিক, হরর, থ্রিলার ও অন্যান্য

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার অবক্ষয় নিয়ে কিছু কথা