মন্দ লেখক সায়ক গোস্বামী


আমি সায়ক। আমি এই মুহূর্তে দরদর করে ঘামছি। ঘেমে যাবারই কথা৷ মেয়েটা আস্তে আস্তে তার শরীরের কাটা দাগগুলো দেখাচ্ছে। আর নিঃশব্দে হাসছে। বড়ই শয়তানী ও অস্বস্তিকর এই হাসি। এই দাগের সঙ্গে কোনও কিছুর যেন মিল আছে। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে এইবার। হ্যাঁ, এগুলো তো সেই কাটার দাগ। 

হঠাৎ করে আমার মন অতীতে চলতে শুরু করে। আমি ফিরে যাই দু'বছর তিন মাস আগের সেই ঘটনায়। একটা সাফল্যের রাত৷ এক কর্পোরেট সংস্থা থেকে বাৎসরিক সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিল। গত বছরের মতো এবছরও জনপ্রিয় সাহিত্যিকের পুরস্কারটা নিতে মঞ্চে উঠেছিলাম আমি, জনপ্রিয় লেখক সায়ক গোস্বামী৷ এই সময়কার প্রেমের উপন্যাস ও সামাজিক গল্প-উপন্যাস লেখায় আমি প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অবশ্য আমার সাফল্যের মূল কারণ হল রাজনীতি, লবিবাজি এবং মার্কেটিং। স্যোশাল মিডিয়ায় আমি টাকা দিয়ে কিছু চাটুকার পুষে রেখেছি। চাটুকারগণ আমার নামে ফেসবুকে গ্রুপ বানিয়ে নিত্যদিন আমার লেখার গুণগান গায়। এছাড়া বেশ কিছু সাহিত্যজগতের শক্তিশালী লোকের সঙ্গে আমার এমন দহরম মহরম আছে যে আমার লেখা বিভিন্ন অডিও ও ভিডিও স্যোশাল মিডিয়ায় জবরদস্তি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক ছোট অডিও চ্যানেলকে আমি টাকা ছড়িয়ে বা কোলাবোরেটিভ প্রোজেক্টের নাম করে হাত করে নিই। 

যাইহোক সেই পুরস্কার গ্রহণের রাতটার কথায় আসা যাক। কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমার শুভাকাঙ্খীরা আমায় ঘিরে ধরল। এদের সঙ্গে বেশ কিছু চাটুকারগণও রয়েছে, যাদের আমি বইপ্রকাশ বা অডিও স্টোরি করতে সাহায্য করে একরকম কিনে রেখে দিয়েছি। সবাই বেশ ছবি-টবি তোলার পর আমি হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছি, তখনই একটা মেয়ের দিকে আমার নজর গেল। মেয়েটাকে চোখধাঁধানো সুন্দরী বললেও কম বলা হয়। মেয়েটা আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আমি মেয়েটার দিকে ভালোভাবে একবার তাকিয়েই চিনতে পারলাম। এই সাহিত্যজগতের রাজনীতিটা আমি আসলে ভালোই পারি। যে সমস্ত লেখক আমার বিপক্ষে চলে যায়, তাদের প্রিয়জনকে আমি টেনে আনি নিজের দিকে। এর ফলে একটা সময় আসে যখন সেই প্রতিপক্ষ একা হয়ে যায়। কারণ তার ঘনিষ্ঠ সবাইকেই আমি আমার শিবিরের লোক করে তুলি। ফলে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে আমার সময় লাগে না। 
এইক্ষেত্রেও তেমনই একটা খেলা আমি খেলেছি। এই মেয়েটার নাম হল শরণ্যা রায়। মেয়েটা হল সাহিত্যিক সৌম্যব্রত চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমিকা। আমি ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে দেখেছিলাম যে সৌম্যব্রত চট্টোপাধ্যায়ের আসল শক্তি হল এই মেয়েটা, শরণ্যা। এই মেয়েটাই ওর হয়ে গলা ফাটায়, ওকে লেখালিখির শক্তি দেয়, সৌম্যব্রতর সমস্ত কিছুকে অন্ধভাবে সমর্থন করে। সৌম্যব্রতর বিরুদ্ধে আমার ঠিক কীসের রাগ আমি জানি না। হতে পারে যে রোমান্টিক গল্প বা সামাজিক উপন্যাস আমি যতটা ভালো লিখি, ও হয়তো তার থেকেও বেশি ভালো লেখে। কিছু ক্ষেত্রে ওর ফ্যানেরা আমার ফ্যানেদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ে যে দুজন লেখকের মধ্যে কে বেশি ভালো লেখে। সবচেয়ে বড় কথা সৌম্যব্রত একবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ওপেন পোস্ট করে বলেছিল যে আমি নাকি সাহিত্যজগতে কোরাপশানের সৃষ্টি করছি। 

মন্দ লেখক সায়ক সায়ক গোস্বামী



ব্যাপারটাতে রেগে লাল হয়ে গিয়েছিলাম। তবু কোনও পাবলিক আপডেট দিইনি। অন্যভাবে প্রতিশোধ নিয়েছি। সৌম্যব্রতকে আটকানোর অনেক চেষ্টা আমি করেছি। বড় বড় প্রকাশককে অনুরোধ করে, সৌম্যব্রতর নামে কুৎসা রটিয়ে আমি সৌম্যব্রতর বিগ হাউজ থেকে বই প্রকাশ করার সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করেছি৷ এছাড়া নিজের ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে কলকাতার কিছু নামী এফ এম চ্যানেলের অডিও স্টোরির অনুষ্ঠানে যাতে সৌম্যব্রতর গল্প কখনও না আসে, তার ব্যবস্থাও পাকাপাকিভাবে করেছি। এছাড়া ছোট ছোট আক্রমণ তো আছেই। কিছু ফ্যানেদের বলেছি যে স্যোশাল মিডিয়ার গ্রুপগুলোতে সৌম্যব্রতর বই নিয়ে কেউ পোস্ট করলে, তাকে সবরকমভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে। আমার এই সব পরিকল্পনা সফলই হয়েছে বলা চলে৷ সৌম্যব্রতর মার্কেট বেশ ডাউন। আর আমার মার্কেট রকেটের মতো সাঁই-সাঁই করে উঠে যাচ্ছে মহাকাশে। কিন্তু এতো কিছু করেও, মনটায় ঠিক শান্তি হচ্ছিল না। কারণটা হল শরণ্যা। 

আরে মেয়ে আমার কাছেও আছে। আমার গার্লফ্রেন্ড হল অন্তরা, তার সঙ্গে আমার তিন বছর ধরে রিলেশানশিপ। কিন্তু শরণ্যার দিকে তাকালেই আমার সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। শরণ্যার কাছে অন্তরা? ধুস। শরণ্যা হল রাজকুমারী। আর অন্তরা হল শরণ্যার প্রাসাদের এক দাসী-বাঁদি। কোনও তুলনাই হয় না। আমার শরণ্যাকে চাই। যে কোনও মূল্যে। নইলে সৌম্যব্রতকে ঠিক ধ্বংস করতে পারছি না। ও নিজেও ফেসবুকে পোস্ট করে জানিয়েছিল যে ওর আগামী বই-ই নাকি ওকে রোমান্টিক লেখক হিসেবে পুঃপ্রতিষ্ঠিত করবে। এবং সৌম্যব্রত নাকি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিল যে কোনও সায়ক গোস্বামীর কোরাপশান ওকে আটকাতে পারবে না। বেশ, এই চ্যালেঞ্জটা আমি উপভোগ করেছি। সৌম্যব্রত জানত না যে ওর বিষদাঁত আমি আর রাখবই না বলে ঠিক করেছিলাম। এবং ওকে যে নৃশংস শাস্তি আমি দেব ঠিক করেছিলাম, সেটার কোনও ধারণাও ওর ছিল না।

আমার ঘনিষ্ঠ একটি সাহিত্য পত্রিকা শরণ্যাকে অতিথি সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে ওদের অফিসে আসতে বলেছিল। শরণ্যা হাসিমুখে তাতে রাজি হয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে শরণ্যা পত্রিকার অফিসে এসে দেখে আমি সেখানে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছি। আমাকে দেখে শরণ্যা কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেছিল। সেটা আমিও লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু পরমুহূর্তেই আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য ওর সঙ্গে হেসে কথা বলি। ওকে কথাপ্রসঙ্গে এটাও বলি যে আমি সৌম্যব্রতর লেখার বেশ বড় একজন ফ্যান। আমি এই কথা বলার পরে শরণ্যার চোখে অবিশ্বাস দেখতে পাই। আমি এটাও যোগ করি যে সৌম্যব্রতর সঙ্গে আমার ঝামেলা নিয়ে মার্কেটে যে কথাটা চালু আছে, সেটা পুরোপুরি রটনা। 

আসলে অনেকে বলে আমি নাকি কথার জাদুকর। কথা দিয়ে মানুষকে,  বিশেষ করে মেয়েদের পুরোপুরি বশ করে ফেলতে পারি৷ শরণ্যাকেও বশ করতে বেশি সময় লাগেনি। এর পরেও শরণ্যা সেই পত্রিকার অফিসে বহুবার এসেছে। আমি পত্রিকার সম্পাদকের কাছ থেকে খবর পেয়ে গেছি যে শরণ্যা আসছে। কোনও ছুতো দেখিয়ে আমি ঠিক সেই সময়ে সেখানে উপস্থিত থেকেছি। প্রতিবারই সুনিপুণভাবে আমি শরণ্যার সঙ্গে নিখাদ ভালোমানুষের মতো ব্যবহার করেছি এবং সৌম্যব্রত সম্পর্কে অহেতুক প্রশংসা করে গেছি। শরণ্যা কিছুই সন্দেহ করেনি। অবশেষে এল সেই দিন। আমার রিডার্স চয়েস অ্যাওয়ার্ড জেতার দিন। অন্য ফ্যানেদের সঙ্গে আমি শরণ্যাকে নেমন্তন্ন করেছিলাম। এছাড়াও আরও দুজন বিশেষ অতিথিকে নেমন্তন্ন করেছিলাম। তারা আসলে কন্ট্রাক্টে কাজ করা দুজন খুনি। তবে বেশ হাই প্রফাইল মার্ডারার। চোস্ত ইংরাজি বলে, ভালো পোষাক পরে এবং ঠান্ডা মাথায় মানুষ শিকার করে। ওরাও ভিড়ের মধ্যে মিশে ছিল। অনুষ্ঠানের পরে যখন শরণ্যার কাছাকাছি এলাম তখন ওরা দুজনও শরণ্যার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি প্রথমে ফ্যানেদের আস্তে আস্তে বিদায় করলাম৷ তারপর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শরণ্যাকে বললাম, "তুমি এয়ারপোর্টের দিকটায় যাবে তো? আমার এই দুজন দাদারাও যাবে। ওরাই তোমায় ছেড়ে দেবে।"

শরণ্যা একবার মৃদু আপত্তি করেছিল, কিন্তু ওর আপত্তিতে আমি তেমন আমল দিই নি। আসলে শরণ্যাকে অনুষ্ঠান চলাকালীন যে কোল্ড ড্রিঙ্ক দেওয়া হয়েছিল, তাতে এমন কিছু ছিল যে ও টলছিল। আমার সঙ্গে থাকা স্পেশাল দুজন ওকে হাত ধরে গাড়িতে ওঠাল। আর আমি ভালোমানুষের মতো শরণ্যাকে গুড নাইট বলে অন্য একটা গাড়িতে উঠলাম অন্তরা আর কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর সঙ্গে। 

না, সেই রাত্রে আর সেরকম কিছু ঘটেনি। পরের দিন একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দেখি যে অনেকগুলো মিসড কল। আমি কলের নম্বরটা দেখে বুঝলাম যে কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করলাম৷ ওপাশ থেকে একজন খুনি ঠান্ডা গলায় বলল, "আপনার কথামতো মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে রেখেছি। এবার আপনি বললে ওকে মেরে ফেলব এখনই।"

আমি উত্তেজিত গলায় বললাম, "না, না, ওকে মেরোনা। দাঁড়াও, আমি আসছি। মেয়েটার সঙ্গে আমার কিছু পুরনো হিসেব বাকি আছে তো।"

আমি ঘণ্টাখানেক পরে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে পৌঁছলাম। দোতলার নির্দিষ্ট ঘরে একটা পুরনো খাট পাতা ছিল। তাতেই শুয়ে ছিল শরণ্যা। তার হাত, পা, মুখ বেশ ভালোভাবেই বাঁধা। আমি খুনিদের উদ্দেশে বললাম, "তোমরা দুজন বাইরে যাও। পারলে একটু নিচে গিয়ে দাঁড়াও। আমি ডাকলে তবে আসবে।"
একজন খুনি গম্ভীর মুখে বলল, "আপনার যা করার তাড়াতাড়ি করুন। আমাদের কাজ শেষ করে বডি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। একজন কাস্টমারের জন্য এতক্ষণ সময় দিলে চলবে না।"
আমার বেশ রাগ হল লোকটার ওপর। কিন্তু আমি রাগটা চেপে রেখে বললাম, "আচ্ছা।"

ওরা নিচে একতলায় নেমে গেল। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম বিছানায় পড়ে থাকা শরণ্যার দিকে। মেয়েটা আমাকে দেখে কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সে বিছানার নোংরা চাদর ঘষে ঘষে দেওয়ালের দিকে সরে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ওর খারাপ লাগছে। খারাপ আসলে আমারও লাগছিল। এই নোংরা রুমে, নোংরা বিছানায় ওর সঙ্গে মাখামাখি করতে আমারও ভালো লাগছিল না। যাইহোক, এখন এত কিছু ভাবার সময় নেই। আমি তাই আমার বাঘের থাবার মতো হাতের পাঞ্জাদুটো বাড়িয়ে শরণ্যার পোষাক খুলতে লাগলাম। ও একটা চাপা গর্জন করছিল। কিন্তু সেই গর্জনে আমার কিছু যায় আসে না। যতক্ষণ না ওর নগ্ন দেহর চামড়া আমি চেটেপুটে খাচ্ছি, ততক্ষণ ওই জানোয়ার সৌম্যব্রতটাকে মানসিকভাবে ধ্বংস করার আনন্দই আমি পাব না। শরণ্যার যে অন্তরে এতদিন ধরে সৌম্যব্রতর অধিকার, সেই অন্তরে অন্তত একবারের জন্য প্রবেশ করব আমি। 

ওহ, শরণ্যা বড্ড দুষ্টুমি করছে। হাত বাঁধা অবস্থাতেই আমাকে বাধা দিচ্ছে। ওকে দুটো চড়-চাপড় দিলাম। উফ, শান্তি। মেয়েটা এবার ঝিমিয়ে পড়ছে। আমি ওর নরম চামড়ার মধ্যে নিজেকে সঁপে দিলাম। ধীরে সুস্থে কাজ শেষ করলাম। তারপর জামা-কাপড় ঠিকঠাক করে হাঁক দিলাম দুজন খুনিকে। ওরা ওপরে উঠে এল। আমি আমার সঙ্গের ব্যাগ থেকে কয়েকটা নোটের তাড়া এগিয়ে দিলাম ওদের দিকে। তারপর রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বেরিয়ে এলাম সেই বাড়ি থেকে। বুকের ভেতরে এক তীব্র উল্লাস। মনের ভেতরে বেশ অন্যরকম শান্তি। মনে মনে ভাবছিলাম যে সৌম্যব্রত যদি জানতে পারত যে তার প্রেমিকার আমি কী হাল করেছি, তাহলে তার হয়তো হার্ট-অ্যাটাকই হয়ে যেত! 

যাইহোক, এসবই হল দু'বছর আগের ঘটনা।  এর পরে আমার মূল উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। প্রেমিকা নিখোঁজের ঘটনায় সৌম্যব্রত একরকম শোকে-দুঃখে-বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে। লেখালিখির জগৎ থেকে সে একরকম বিদায় নিয়েছে বলা যায়। বাংলা রোমান্স ফিকশানের জগতে সায়ক গোস্বামী এখন মুকুটহীন সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কিছু একটা যেন বদলে গেছে। ইদানিং আমার তেমন নতুন লেখার প্লট মাথায় আসে না। বিদেশি সাহিত্যের অনুকরণে কিছু গল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে৷ ফেসবুকে কিছু পাঠক আমাকে চোর বলে গালাগালি দিয়েছে। আমার ফ্যানেরা সঙ্গে সঙ্গে সেই সব পাঠকদের আক্রমণ করেছে, কিন্তু তাতেও ড্যামেজ কন্ট্রোল যেন ঠিকঠাক হয়নি। যত দিন যাচ্ছে আমার সম্পর্কে যেন একটা নেগেটিভ ভাইব স্যোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ বলছে আমার গল্প চুরি করা, কেউ বলছে যে আমার গল্পের লজিক ঠিকঠাক থাকে না। এছাড়া মাঝখানে অন্য ঝামেলাতেও ফেঁসে গেছিলাম। যেহেতু শরণ্যাকে শেষ দেখা গেছিল আমার সঙ্গে, তাই পুলিশ বারে বারে এসে আমাকে জেরা করেছে। মিডিয়ার লোক এসে আমাকে প্রশ্ন করেছে। ফেসবুকে আমার সম্বন্ধে উড়ো খবর বেরিয়েছে শরণ্যার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে নাকি আমার হাত আছে। ভাগ্যিস আমার অনেক ক্ষমতা এখন। তাই শাসক দলের মন্ত্রীদের টাকা খাইয়ে পুলিশের হাত থেকে কোনও রকমে বেঁচেছি। আরও একটা কথা, স্বয়ং অন্তরাও শরণ্যা নিখোঁজের ব্যাপারে আমাকে দোষী ভেবেছিল। তাই ওর সঙ্গে প্রবল অশান্তি করে ওকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।

কিন্তু তাতেও কি শেষ রক্ষা হয়েছে? আসলে পার্থিব জগতের বিপদগুলো থেকে বাঁচলেও অপার্থিব জগতের অজানা ভয় আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আজ থেকে মাসখানেক আগে জানতে পারি যে আমি আবারও একটি সাহিত্য পুরস্কার পেতে চলেছি। আর তারপরেই কিছু অন্যরকম ঘটনার সূত্রপাত। একদিন কলেজ স্ট্রীট ধরে হাঁটতে হাঁটতেই দেখি একটা মেয়ে আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মেয়েটার মুখটার সঙ্গে কার যেন অদ্ভুত সাদৃশ্য। কার? আরে, ঠিক শরণ্যার মতো না? কিন্তু সেটা কী করে হয়? না, না, আমারই ভুল। 

তারপরে একদিন একটা নতুন মেয়েকে ভোগ করছিলাম। এই মেয়েটা আমার অন্ধ ভক্ত। তার সঙ্গে একটু আধটু গান জানে। আমি ওর সঙ্গে একটা গান গাওয়ার জন্য ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। মেয়েটাকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নাম করে এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি আর সেখানেই ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করি। মেয়েটা প্রথমে আপত্তি করলেও, কিছু বাঁধাধরা প্রেমের ডায়লগ বলতেই সে আর আপত্তি করেনি। আমি তাকে চুমু খেতে খেতে হঠাৎ দেখি আমার খুব কাছে শরণ্যার মুখ। তার শরীরে এগুলো কী? এগুলো যে কাটা কাটা দাগ। যেন তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কেউ প্রথমে কেটে ফেলে তারপর আবার সেলাই করে জুড়ে দিয়েছে! এ... এসব কী দেখছি আমি! আমি ছিটকে সরে আসি। পরক্ষণেই দেখি যে শরণ্যা নয়, সেই নতুন মেয়েটাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার আচরণে সে স্তম্ভিত। 

এর পরে একটা একটা দিনের সঙ্গে শরণ্যার ছায়া আমার জীবনে গভীর হয়েছে। শাওয়ারে চান করতে করতে দুটো কাটা হাত আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। হাতদুটোতে শরণ্যার হাতের মতো চুড়ি। আমি চিৎকার করে উঠেছি। পরক্ষণেই দেখেছি যে কোথাও কোনও হাত নেই। রক্তের ক্ষীণ ধারা জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। রক্ত কোথা থেকে এলো? তবে কি আমিই আমার বুকে আঁচড় কেটেছি? এরপরে চান করা মাথায় উঠেছে। হন্তদন্ত হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছি। 

এখানেই শেষ নয়। খেতে বসে দেখেছি যে রান্নাঘর থেকে কার যেন মৃদু হাসির শব্দ আসছে। হাসির শব্দটা ঠিক শরণ্যার মতো। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেছি। দেখেছি যে গ্যাসের নব বন্ধ করতে ভুলে গেছিলাম। কিন্তু তা কেমন করে হয়? আমি যে ঠিকই গ্যাস বন্ধ করেছিলাম। 

কী ভাবছেন যে ঘটনার এখানেই শেষ? নো, নো, ওয়েট। আরও আছে। গত কয়েকদিনে যে কোনও মেয়ে আমার কাছাকাছি এলেই আমি যেন শরণ্যার শরীরের গন্ধ পেয়েছি। আমার মনে হচ্ছে যে এসবই আমার মনের ভুল। কিন্তু সব মেয়ের ক্ষেত্রেই এমন মনের ভুল কী করে হয়? আমার নিজের নাকই বেইমানি করছে! 

এবার শেষ ঘটনাটায় আসি। আগামীকাল পুরস্কার প্রাপ্তির অনুষ্ঠান। উপস্থিত থাকবেন এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের প্রায় সমস্ত প্রথম সারির লেখকগণ। সবার সামনে থেকে পুরস্কার নেওয়ার সময় আমাকে স্পিচ দিতে হবে। এমন কিছু বলতে হবে যাতে আমাকে একজন স্ট্রাগলার মনে হয়। যেন মনে হয় যে আমাকে অনেকেই চেপে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি শীর্ষে উঠেছি। এবং কিছু মিষ্টি প্রেমের বাক্য বলতে হবে ফ্যানেদের উদ্দেশে। তাহলেই কাজ হাসিল। তাই স্পিচের কথাগুলোই ভেবে নিচ্ছিলাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে। ঠিক এমন সময় ঘরটায় আলোর তেজ কেমন যেন কমে এল। দপদপ করতে করতে একসময় সেটা নিভেও গেল। পরক্ষণেই সেটা আবার জ্বলে উঠল। আমার সামনে এক নগ্ন নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। শরণ্যা! 

শরণ্যার গোটা শরীর জুড়ে কালো কালো মোটা মোটা দাগ। সেই দুজন খুনি কী এভাবেই ওর শরীরটাকে টুকরো টুকরো করেছিল? উফ, আমি কিছু ভাবতে পারছি না। কিন্তু, শরণ্যা আমায় ভাবতে বাধ্য করছে। কী চায় সে? 

শরণ্যা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাঁটুদুটো রেখেছে আমার ঊরুর দুপাশে। তার মুখে রক্ত জল করা হাসি। তার কবজি থেকে কাটা হাতের পাঞ্জা বিষাক্ত বিছের মতো আমার বুকের ওপর চলে বেড়াচ্ছে৷ আমি তীব্র চিৎকার করছি। করেই চলেছি। শরণ্যা হাসছে, নিঃশব্দে, মিটিমিটি হাসছে। 

আস্তে আস্তে তার মুখের হাঁ-টা বড় হচ্ছে। কিন্তু মুখের ওই বিরাট গহ্বরের ভেতর ওগুলো কী? ছুরির ফলার মতো দাঁতের সারি এবং তীব্র, আঠালো একটা জিভ। তার মাথাটা আমার মুখ লক্ষ করে নেমে আসছে। না, আমি চাইনা ওর আদর, আমি চাই না।

কিন্তু, আমার চাওয়া-না-চাওয়ায় কী আসে যায়। আমি তীব্র যন্ত্রণায় ভেসে যাচ্ছি। কারণ শরণ্যারূপী দানব আমার চামড়ায় কামড় বসাচ্ছে। উফ, কামড়ে, খুবলে মাংস ছিঁড়ে নেওয়ার যে কী যন্ত্রণা, সেটা এখন টের পাচ্ছি। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। তারপর একসময় জ্ঞান ফিরল।

জ্ঞান ফিরতে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। শরীরে আর ব্যথা-বেদনা একটুও নেই। তবে কী পুরোটাই স্বপ্ন ছিল? না, না, না।

এই তো আমার শরীরটা বিছানায় পড়ে আছে। আমার ঠোঁট, কানের লতি, চোখের পাতা, গালের চামড়া বেশ ভালোভাবেই ভক্ষণ করেছে শরণ্যা। আমার মাথাটাকে গলা থেকে মুচড়ে দিয়েছে পরম যত্নে। এসব করে দিয়ে সে চলে গেছে। তার আর কিছু চাইবার নেই তার থেকে। এবার আমি তবে কী করব? 

ওহ চারপাশে অন্ধকার কেমন যেন ঘন হয়ে আসছে। আমি... আমি কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছি না। আমার চারপাশের ঘরের পরিবেশ আস্তে আস্তে আমার থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এক অন্ধকারের মেঘ আমার শরীরটাকে ঘিরে ধরেছে। কোনও কিছু যেন আমার জাপ্টে ধরেছে। কী সেটা? ওহ, একজোড়া বিশাল হাত। সেটা আমাকে টেনে নামাতে চায় নিচের দিকে। আমি ছাড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেই দানবীয় হাতের বাঁধন ভয়ানক। সেটা আমাকে টেনে নামাচ্ছে নিচের দিকে। আমি নামতে টের পাচ্ছি যে উষ্ণতা ক্রমশ বাড়ছে। নিচে জোরালো লাল আলোর আভা দেখতে পাচ্ছি। আমি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি আগুনের মধ্যে। নরকের আগুনের মধ্যে। 

(গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক)
 
©বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় / Biswajit Ganguly

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আন্তির্জাতিক নারীদিবসের উৎস ও প্রয়োজনীয়তা

বাংলা অডিও গল্প - ভৌতিক, হরর, থ্রিলার ও অন্যান্য

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার অবক্ষয় নিয়ে কিছু কথা