আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষণ, কলকাতায় প্রতিবাদ মিছিল এবং বিচার

আপনি যদি বাঙালি হন তবে আপনাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। আপনি জানেন যে ৯ আগস্টের রাতে আর জি কর হাসপাতালের সেমিনাররুমে কী ঘটেছিল। কোনও মেয়েকে যতটা বিকৃতভাবে ধর্ষণ করা যায়, ততটাই করা হয়েছে। যতটা নির্মম ও নারকীয়ভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যায়, সেটাই করা হয়েছে। সুতরাং এর বিরুদ্ধে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষ যে সোচ্চার হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

এমন প্রতিবাদ আমি জীবদ্দশায় দেখিনি। এবং আমি বলব, এমন রক্তপাতহীন প্রতিবাদও আমি দেখিনি। একটা কথাই বলা যায়, যেসব মহিলা ১৪ আগস্টের রাতে মেয়েরা রাতের দখল নাও বলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় সমবেত হয়েছিলেন, তাঁদের সাহস, প্রতিবাদী মনোভাব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করে। এঁরা সত্যিকারের বাঙালি মেয়ে এবং বাঘিনীর মতো ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। এঁদের আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে কোনও কথা হবে না! এবং তাছাড়াও বলব এঁদের মধ্যে প্রায় বেশিরভাগই ফেসবুকে বা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও সামাজিক লড়াইটাকে এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। এই ইস্পাতকঠিন মানসিকতাকে প্রণাম জানানো ছাড়া আর কী বা করার থাকতে পারে!

প্রতিবাদ ও রাজনীতি:

রাজ্যের বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন ঘরে সরকারবিরোধী লড়াই করার জন্য একটা শক্তিশালী ইস্যু খুঁজছিল। নারী ধর্ষণ ও হত্যা হল এমন একটা ঘৃণ্য ও স্পর্শকাতর বিষয়, যেটার বিরুদ্ধে চট করে রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধ করা যায় না। যেহেতু এই ধর্ষণের ঘটনায় প্রথম থেকেই বিভিন্ন বিষয় রহস্যময়ভাবে অন্ধকারে থেকে গিয়েছে, ফলে বিরোধীপক্ষের জমি শক্ত হয়েছে। বামফ্রণ্ট ও বিজেপি রীতিমতো আটঘাঁট বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এইক্ষেত্রে বামফ্রণ্টের লড়াই খুবই বুদ্ধিমানের। খেয়াল করে দেখুন, সিমিএম নেতারা বা নেতৃরা চট করে সামনে আসছে না। বরং unidentified সিপিএম কর্মী, তারা সবাই আস্তে আস্তে আন্দোলনটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আসলে সিপিএমই আন্দোলনটাকে পরিচালনা করছে, কিন্তু বলা হচ্ছে এটা মানুষের আন্দোলন। এবং আন্দোলনের পুরোভাগে কিছু সাধারণ মানুষকে রেখে দেওয়া হয়েছে, যারা তিলোত্তমার (মতান্তরে অভয়ার) মর্মান্তিক মৃত্যুর বিচার চাইতে চাইতে একরকম ক্ষেপে গেছে। বন্য পশুর মতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সরকারপক্ষের যেই সামনে আসছে, তাদেরকেই গালাগালি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে ভরিয়ে দিচ্ছে।

এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব কী হবে, আমি জানি না। সেটা জানতে হলে আমাদের ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সরকার কি দোষী?

জনগণের একটা বৃহৎ অংশ বলছে যে এই ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় সরকার জড়িত। কিন্তু আমি সেটা বলব না। কারণ কলকাতা পুলিশ ইতিমধ্যেই তদন্ত করেছে এবং এখন তদন্ত করছে ইডি ও সিবিআই। এবং কোর্টের রায় এখনও বেরোয়নি। সুতরাং বলা সম্ভব নয় যে ঠিক কী কে বা কারা দোষী! তবে সরকার বা সরকার ঘনিষ্ঠ যদি দোষী প্রমাণিত হয়, তবে তার থেকে দু:খজনক আর কিছুই হবে না। দেখা যাক, অদূর ভবিষ্যতে কোর্ট কী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়!

মূল ঘটনা ও আন্দোলনের কিছু খারাপ ঘটনা:

১) আন্দোলন চলাকালীন আর জি কর হাসপাতালে কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতিদের হামলা। পুলিশের সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করা উচিত ছিল।

২) ক্রাইম সিনের অনতিদূরে একটি ঘর মেরামত করা। কেন, এই মেরামতির কাজ আর দু'মাস পরে করা যেত না?

৩) কেস যখন সিবিআইকেই দেওয়া হবে বলে দ্রুত ঠিক হল, মৃতদেহকে তাড়াতাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হল কেন? মৃতদেহটিকে একবার অন্তত সিবিআইয়ের তদন্তের জন্য সংরক্ষিত রাখা উচিত ছিল।

৪) কিছু মানুষ ধর্ষিতা ও মৃতা ডাক্তারের ছবি ও আসল নাম স্যোশাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দিয়েছে। এটা চূড়ান্ত অনৈতিক কাজ। এর জন্য এদের শাস্তি হওয়া উচিত। 

৫) জুনিয়র ডাক্তারদের অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি। একে তো সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রচুর পরিমাণ রোগী আসে চিকিৎসা করাতে। তার ওপর যদি জুনিয়র ডাক্তারেরা চিকিৎসায় সাহায্য না করে, তবে গোটা স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো ভেঙে পড়তে বাধ্য! এবং তাই হয়েছে। বহু মানুষ সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে আরও ভুগেছে শারীরিক ও মানসিকভাবে। এইসব ভোগান্তির দায় ডাক্তারেরা অস্বীকার করতে পারে না। আমি ডাক্তারদের আন্দোলনের মানসিকতাকে সম্মান করি, তাদেরকে মানুষ হিসেবেও পছন্দ করি, কিন্তু তাদের কর্মবিরতিকে সমর্থন করি না।

৬) কলকাতার ট্রাফিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে দিনের বেলায় পদযাত্রার জন্য। বহু অফিস ও অন্যান্য কাজে যাওয়া যাত্রী এই পদযাত্রার জন্য জ্যামে ফেঁসে গিয়ে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু সেই ঘটনা নিয়ে প্রতিরোধ বাহিনী উদাসীন। একজনের জন্য বিচার চাইতে গিয়ে যে তারা গোটা শহরের ট্রাফিকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, সেই ব্যাপারে তাদের কোনও বোধই নেই। কী অমানবিক!

৭) কিছু সেলেব্রিটি বিভিন্ন রকমের কৃত্রিমভাবে তাঁদের ব্যথা-বেদনা জানিয়েছেন। সেটা কেন, তাই তো বুঝলাম না। সবকিছু নিয়েই ফুটেজ খেতে হবে? ধর্ষণ নিয়ে পাবলিসিটি স্টান্ট করা যায়?

৮) অবশ্য বিখ্যাতদের বলে কী হবে? সাধারণ মানুষকে কী বলবেন? কিছু ব্যক্তি ফেসবুকে আপডেট দিচ্ছে, 'যতই রিচ ডাউন হোক, আমি প্রতিবাদ চালিয়েই যাব।' সেই সব পোস্টে একশ লাইক ও পঞ্চাশ কমেন্ট পড়েছে। এটা রিচ ডাউন! এর থেকে বড় আয়রনি আর কিছু হয়! এমন ফুটেজখোর বহু মানুষকে ফেসবুকে দেখা গেছে যারা ধর্ষণবিরোধী পোস্ট করে নিজেদের পোস্টের রিচ ও এনগেজমেন্ট বাড়িয়ে নিয়েছে। ধর্ষণ নিয়ে মার্কেটিং! অভাবনীয় রকমের ক্রাইম ও ধিক্কারযোগ্য ব্যাপার। অনেক জনগণ আবার মিছিলে গিয়ে জমায়েতের ছবি না তুলে নিজেদের সেলফি ও গ্রুফি তুলে বাড়ি চলে এসেছে। ভাবতে লজ্জা লাগে যে এর মধ্যে আমার এক পরিচিতও আছে! ছি:।

ধর্ষকদের ওপর প্রভাব:

আন্দোলনের ফলে হয়তো কিছু খারাপ মানুষের বিবেক জাগ্রত হবে। কিন্তু আসলে যারা এই ধরণের অপরাধ করে, তারা মোটেও ভয় পাবে না। এর পরেও মেয়েদের ওপর অত্যাচার হবে। সত্যি কথা বলতে গেলে, যবে থেকে আর জি করের প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, সেই দিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশে বেশ কিছু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার প্রমাণ খবরের কাগজগুলোতে রয়েছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ধর্ষণ এক সামাজিক ক্যান্সার যেটা থেকে মুক্তি সম্ভব নয়। আমরা মানুষেরা কেবল প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতে পারি, ধর্ষণ থামাতে পারি না।

যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের কাছে আমারও একটা প্রশ্ন আছে। শুধু একটা ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদ করছেন কেন? বাকিরা কি মেয়ে নয়? বা নিগৃহীত বালক বা বালিকা নয়? তাদের শ্লীলতাহানির ঘটনারও প্রতিবাদ করুন। প্লিজ, করুন। রাজনৈতিক দাদাদের কথা শুনে প্রতিবাদ করবেন না, দিকে দিকে ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে সরব হোন।

'শেষ করুন':

এই ব্লগ পোস্টের শেষে একটাই কথা বলার। চাইব যে বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হোক। একটা ধর্ষণের ঘটনা ঘিরে অনেক কিছু হল। এবার বিচারপতি রায় দিন। ব্যাপারটাকে শেষ করুন। দোষীদের ও দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দিন। দিয়ে শেষ করুন। রাজ্যের অন্যান্য সরকারী ও বেসরকারি হাসপাতালে যদি অন্যায় কোনও দুনম্বরী চক্র চলে, সেগুলো নিয়ে দ্রুত তদন্ত করুন। সেইসব চক্র ভেঙে দিন। দিয়ে ব্যাপারগুলোকে শেষ করুন।

নইলে অপেক্ষা করতে করতে জনগণের একাংশ নিজেদের ওপর আশা-ভরসা সব হারিয়ে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাবে!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আন্তির্জাতিক নারীদিবসের উৎস ও প্রয়োজনীয়তা

বাংলা অডিও গল্প - ভৌতিক, হরর, থ্রিলার ও অন্যান্য

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলা ভাষার অবক্ষয় নিয়ে কিছু কথা