আন্তর্জাতিক দাবাখেলায় বাঙালিরা কোথায়?

নরওয়ে চেজ ২০২৫ ইভেন্টের শুভসমাপ্তি ঘটল। ম্যাগনাস কার্লসেন সপ্তমবারের জন্য এই শীর্ষে থেকে এই খেতাব জিতলেন। তা বেশ। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় তাঁকে বেশ ভালোরকম ভাবে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন ডি গুকেশ। অল্পবয়সী, নম্র-ভদ্র ব্যক্তিত্বের এই ছেলেটিকে অল্পক্ষণ দেখলেই ভালো লাগে। ব্যবহার বা শরীরী ভাষায় কোনও ঔদ্ধত্য নেই; এ যেন পুরোপুরি ভারতীয় আদর্শে দীক্ষিত! আগেকার দিনে বলা হত ক্রিকেট নাকি ভদ্রলোকেদের খেলা। বর্তমানের দাবাখেলায় গ্র‍্যান্ডমাস্টারদের শরীরী ভাষা দেখলে বলতে ইচ্ছে করে, ক্রিকেট নয়, আসলে দাবা খেলাই হল ভদ্রলোকেদের খেলা। অবশ্য গুকেশের কাছে হেরে কার্লসেনের টেবিলে ঘুঁষি মারার প্রসঙ্গ কেউ কেউ তুলতে পারেন, কিন্তু আমার মনে হয়, সেটা কেবলই একটা ব্যতিক্রম। কারণ কার্লসেন কিন্তু পরমুহূর্তেই গুকেশের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন এবং পরে পিঠ চাপড়ে দেন। স্পষ্টতঃই এটা খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের পরিচয় এবং এমন দৃশ্যই দিনের শেষে বিশ্বখ্যাত একজন দাবাড়ুর থেকে প্রত্যাশিত।



দাবা খেলার ইতিহাস ভারতে বহুকালের। সম্ভবত, যখন এই খেলা প্রচলিত হয়, তখন এর নাম ছিল চতুরঙ্গ। তারপর বহু পথ পেরিয়ে এই খেলা ভারতসহ বিশ্বময় জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এবং আজকে বিশ্বের 'টপ টেন' বা সেরা দশ দশ গ্র‍্যান্ডমাস্টার র‍্যাঙ্কিয়ে ভারত থেকেই চারজন। ভাবা যায়! এই চারজন হলেন:

ডোম্মারাজু গুকেশ - র‍্যাঙ্ক ৫

অর্জুন ইরিগাইসি - র‍্যাঙ্ক ৪

প্রজ্ঞানন্দ - র‍্যাঙ্ক ৬

অরবিন্দ চিদাম্বরম - র‍্যাঙ্ক ৯

(র‍্যাঙ্কিং যে কোনও সময় পরিবর্তন হতে পারে)

খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক ভারতীয়ই এই পরিস্থিতিতে আনন্দ অনুভব করবেন। আমার কাছেও স্বদেশীয় গ্র‍্যান্ডমাস্টারদের এই সাফল্য ঈর্ষনীয় ও গর্বের। কিন্তু এইখানেই একটা প্রশ্ন আছে আমার।

এই চারজন ভারতীয় গ্র‍্যান্ডমাস্টার সবাই দক্ষিণ ভারতের।

দাবা খেলা নাকি প্রচন্ড বুদ্ধির খেলা। তা, বাঙালির বুদ্ধি নাকি ভারতসেরা! আমরা ধাঁধা নিয়ে মেতে থাকি, আমাদের গোয়েন্দারা হলেন ফেলুদা ও ব্যোমকেশ! তাহলে বাঙালি গ্র‍্যান্ডমাস্টার সেরাদের দৌড়ে নেই কেন? শেষ এক বাঙালি গ্র‍্যান্ডমাস্টারের নাম শুনতাম: সূর্যশেখর গাঙ্গুলী। তা, তাঁর পরে পশ্চিমবঙ্গে দাবাখেলায় গ্র‍্যান্ডমাস্টাররা সেইভাবে সেরা হতে পারছে না কেন? কীসের সমস্যা আমাদের? পরিকাঠামো? উন্নতমানের কোচ?

আমার মনে হয়, বাঙালির সমস্যা অন্য জায়গায়। বাঙালির 'ফোকাস' নড়ে গেছে। সাধারণ বাঙালি ছেলে-মেয়েকে নাচ-গান শিখিয়ে রিয়ালিটি শোতে নিয়ে যেতে চায়, বাঙালি যুবক চায় ইউটিউবে অডিও স্টোরি বানিয়ে কামাতে আর সরকারি চাকরির চেষ্টা করতে এবং বাঙালি গৃহবধু চায় ফেসবুকে রিল বানিয়ে উপার্জন করতে। বাঙালি লোকেরা আর বই পড়ে না, তাদের চোখ থাকে সরকার আর কী নতুন দুর্নীতি করল। বাঙালি বলবে যে সরকার শিল্প আনতে পারে না, এদিকে নিজেরা উদ্যোগী হয়ে প্রাইভেট কোম্পানি খুলে ২০ জন লোককে চাকরি দিতে পারে না।

যে টাকা-পয়সা খেলাধুলো, পরিকাঠামো উন্নতি ও শিল্পে খরচ করা উচিত, সেই টাকাই খরচ হয় বিভিন্ন পুজোতে বা ধর্মীয় উৎসবে। ফলে সামগ্রিকভাবে রাজ্যটা পিছিয়ে পড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে দাবা খেলাতেও।

বাঙালির এই গুটিয়ে যাওয়া মানসিকতা, লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া মানসিকতা থাকলে, দাবাখেলা সহ বিভিন্ন খেলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে আমাদের অনেক সময় লেগে যাবে। চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে ব্যাঙ্গালোর-হায়েদ্রাবাদ-চেন্নাইয়ের কাছে পশ্চিমবঙ্গের চাকরিপ্রার্থীরা অনেকদিন আগেই হার মেনেছে। এবার খেলাধুলোতেও দক্ষিণ ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব ভারতসেরা হবে।

পশ্চিমবঙ্গ সহ বাকি ভারত শুধু ধর্ম, রাজনীতি, সরকারের সমালোচনা নিয়ে মেতে থাকুক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলা অডিও গল্প - ভৌতিক, হরর, থ্রিলার ও অন্যান্য

আন্তির্জাতিক নারীদিবসের উৎস ও প্রয়োজনীয়তা

আর জি করের ঘটনা থেকে যা বুঝলাম